‘বসুন্ধরার মতো আরো করপোরেট দল চাই’

বাংলাদেশ ফুটবলের সমার্থকই হয়ে গেছেন কাজী সালাউদ্দিন। শুধু খেলোয়াড় হিসেবেই মাঠ মাতিয়েছেন- এমনটা নয়, কোচ এবং সংগঠক হিসেবেও বরাবরই তিনি চ্যাম্পিয়ন।

বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে অনেক পরিকল্পনা তার। তিনিই ভালো জানেন, এ দেশের ফুটবল কেমন চলছে। তার মতে, বাংলাদেশের ফুটবল আরো ভালো চলবে যদি বসুন্ধরা কিংস, সাইফ স্পোর্টিংয়ের মত আরো কয়েকটি করপোরেট হাউজ আসে ফুটবলের প্রতিদ্বন্দ্বীতায়।

বাফুফে সভাপতি হিসেবে একযুগেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাভাবিকভাবেই সমালোচনা আছে তার নামেও। যে কারণে কাজী সালাউদ্দিন এবং তার কমিটির নামে দুদকে পর্যন্ত নালিশ গেছে। শেষ পর্যন্ত দুদকের তদন্তে পুরোপুরি ক্লিন শিট পেয়ে গেছেন।

সব ধরনের গুজব, গুঞ্জণকে পেছনে ফেলে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের ফুটবলকে। এসব নিয়েই বাংলাদেশের ফুটবল বিষয়ক প্রথম নিউজপোর্টাল ‘ফুটবল বাংলাদেশ.কম’-এর সাথে সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত কথা বলেছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন।

আজ থাকছে সাক্ষাৎকারের তৃতীয় পর্ব। আগের সাক্ষাৎকারগুলো পড়ুন

(পর্ব-১)‘২০০ কোটি টাকার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাব’

(পর্ব-২) : ‘আমি এই কোচকে নিয়ে সন্তুষ্ট নই’

পবিত্র: আপনি বাংলাদেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় আইকন, দেশের ফুটবলের প্রায় সমার্থক শব্দ। আপনার চেয়ে ফুটবলটাকে আর কেউ ভালো জানে না। আপনি নিজে বলেন তো বাংলাদেশের ফুটবল কেমন চলছে?

সালাউদ্দিন: আজকের পৃথিবীর পরিস্থিতি বিবেচনায় আই অ্যাম প্রিটি স্যাটিসফায়েড। এটা উপরেই যাবে, নিচে নামবে না। আমি ক্লাবগুলোর খুব প্রশংসা করি। তারা দুর্দান্ত কাজ করছে। আমি আরো দু-তিনটি কর্পোরেট টিম চাই বসুন্ধরার মতো। তাহলে চেহারাটা অনেক ভালো হবে।
আমাকে একটু সমর্থন দেন। মিডিয়ার সমর্থন দরকার। কারণ ফুটবল হলো একমাত্র বৈশ্বিক খেলা। ক্রিকেটের মতো খেলাগুলো মাত্র ১০-১২টি দেশ খেলে। ফুটবল দুশোর বেশি দেশ খেলে। এবং প্রতিটি দেশই ফুটবলে উন্নতির জন্য লড়াই করে।

পবিত্র: কিন্তু আপনি যতই বলেন বাংলাদেশের ফিফা র‌্যাঙ্কিং তো বাড়ছে না। তিন-চার বছর ধরে র‌্যাঙ্কিং সেই ১৮৪ থেকে ১৮৭-এর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

সালাউদ্দিন: না, না, এটার আরো ব্যাপার আছে। ফিফা র‌্যাঙ্কিং শুধু খেলেই বাড়ে না। এজন্য কিছু পলিসি করতে হয়। বছরে ৩০-৪০ কোটি টাকা দরকার। প্রতিটি ফিফা উইন্ডোতে ৫-৬ টি প্রীতি ম্যাচ খেলতে হবে। আমরা এখন বেশি বেশি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলার চেষ্টা করে যাব। অলরেডি সেটা দেখতে পাচ্ছেন।

পবিত্র: আপনি বলছেন ফুটবল ক্লাবগুলো ভালো করছে। আগে কিন্তু ক্লাবগুলোর বেশ কয়েকটি আপনার বিরুদ্ধে ছিল। এখন কি তাদের ধারণা পাল্টে গেছে, পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন তাদের?

সালাউদ্দিন: না, না আপনার বক্তব্য সংশোধন করে দিই। কিছু কিছু ক্লাব ভালো করছে। আর ক্লাবগুলো কখনো আমার বিরুদ্ধে লাগেনি। আমি ২০০৮ সালে প্রথমবার পাশ করেছি পুরোপুরি তাদের সমর্থনে। এখনো তাদের সমর্থন পাই। ক্লাবগুলোই আসলে ফুটবলকে ভালোবাসে।

পবিত্র: জেলা পর্যায়ে আপনাকে নিয়ে একটা ধারণা আছে যে আপনি ডিএফএ তৈরি করে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে বিরোধ বাঁধিয়েছেন। পদাধিকারবলে জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রধান হলেন ডিসি বা জেলা প্রশাসক। তারা তো একসময় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন আপনার ওপর।

সালাউদ্দিন: জেলা প্রশাসকদের একটি ভুল আমি ভাঙিয়ে দিই। ডিএফএ আমি করিনি, ফিফা করেছে। প্রেসক্রিপশন ছিল আমার পূর্বসূরি এসএ সুলতানের। আমি বরং পরে এসে আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি।

আমি ১২টি চিঠি লিখেছি ফিফার কাছে। পয়সা খরচ করে জুরিখে ফিফার কাছে পাঠিয়েছি হারুনুর রশিদ ও বাদল রায়কে। আমি ফুটবল ফেডারেশনে জেলার প্রতিনিধিত্ব আগের মতো করে ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। হবে কি না জানি না। সমস্যা হলো কী, আমি যে অনেক কাজ করি সেটা অনেকে জানে না।

পবিত্র: আপনি তো সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিতে পারেন কী কাজ আপনি দেশের ফুটবলের জন্য এ পর্যন্ত করেছেন আর কী করতে চান।

সালাউদ্দিন: হ্যাঁ, করতেই পারি। কিন্তু আমি নিজের কথা বেশি বলতে পছন্দ করি না। তবে মিডিয়া সহযোগিতা করলে দেশের ফুটবলের জন্যই ভালো হবে। তাছাড়া আমি রাজনীতি করি না। ফুটবল নিয়েই পড়ে থাকি।

পবিত্র: আপনি পলিটিশিয়ান নন ঠিকই, কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনের অনেকেই বলেন আপনি মস্ত পলিটিশিয়ান। না হলে এত বিরুদ্ধবাদিতা সত্ত্বেও টানা চতুর্থবার কী করে জিতে যান নির্বাচনে?

সালাউদ্দিন: হা হা (হাসি)। আমি আমার মতো করে চলি। আমি ধন্যবাদ দিই আমার সব সমর্থককে যারা আমাকে বারবার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

পবিত্র: নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে এমন বিধিনিষেধ তো নেই যে চারবারের বেশি নির্বাচন করা যাবে না। তাহলে কি আপনাকে পঞ্চমবারের মতো বাফুফের সভাপতি পদে দেখা যাবে?

সালাউদ্দিন: না, বিধিনিষেধ নেই। আমি নির্বাচন করতে পারব। তবে নির্বাচন করব কি না সময়ই বলবে।

পবিত্র কুন্ডু: কিন্তু আপনি ফুটবলের জন্য এত কাজ করার পরও তো বাফুফে বা আপনার সমালোচনা বা নিন্দা চলছেই। এই যে কদিন আগেই একটা খবরে সারাদেশ তোলপাড় হলো যে ফিফা অনিয়ম খুঁজে পেয়ে বাফুফের অনুদান বন্ধ করে দিয়েছে। আপনারা বললেন, অনুদান বন্ধ করেনি। ওরা সিস্টেম বদলে একজন পরামর্শক নিয়োগ দিতে চায়। বিষয়টি কি ঠিক হয়ে গেছে?

সালাউদ্দিন: হ্যাঁ, আমরা এটিকে স্বাগত জানিয়েছি। খুব শিগগিরই পরামর্শক (কনসালট্যান্ট) নিয়োগ দেবে তারা। এতে আমাদেরই সুবিধা হবে। করোনার জন্য হয়তো একটু দেরি হচ্ছে। তবে পারলে আমি চাই কালই হোক।

পবিত্র: পরামর্শকের বেতন কি বাফুফেকে বহন করতে হবে?
সালাউদ্দিন: না, না, ওটা ফিফার বাজেটের মধ্যেই ধরা থাকবে।

পবিত্র: বিষয়টি নিয়ে বাফুফের ওপর দিয়ে কটা দিন বেশ ঝড় বয়ে গেল।

সালাউদ্দিন: এটা অপ্রত্যাশিত। এটা আসলে কোনো ব্যাপারই না, খুব সিম্পল। শোনেন, একটু বুঝিয়ে বলি। ধরেন মহিলা ফুটবল ক্যাম্পে কাঁচা বাজারের খরচ নিয়ে কথা উঠল। কাঁচা বাজারের রশিদ তো আপনি পাবেন না। ওরা চেক দেখতে চায়। তো আমরা পরে সুপার শপের সঙ্গে চুক্তি করলাম, যেমন আগোরা বা মীনা বাজার। ওরা নির্দিষ্ট মূল্য তালিকা অনুযায়ী চেকের বিনিময়ে জিনিস দেয়।

আবার সুপার শপে কাঁচা বাজারের তুলনায় ১৫% শতাংশ দাম বেশি হয়। এটা নিয়ে ওরা বলল সংশোধন করেন। এটা তো কোনো সমস্যা নয়, এটা নিয়ে কেন হইচই করতে হবে। অনুদান কখনোই বন্ধ হয়নি। ফিফা বা এএফসি থেকে প্রতি বছরই অডিট হয়, তারা তাদের পর্যবেক্ষণ দেয়। আগের ১২ বছর ধরে সেটাই হয়ে এসেছে। এবার হঠাৎ করে এটা নিয়ে মিডিয়ায় হইচই করা হলো। কিন্তু অনেকের হয়তো জানা নেই এই হইচইয়ের মধ্যেও ফিফা নিয়মিত অনুদানের ১ লাখ ডলার পাঠিয়েছে। এবার কী বলবেন?

পবিত্র: মানুষের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে ফিফা বা এএফসি’র সঙ্গে কাজী সালাউদ্দিনের যে যোগাযোগ বা উষ্ণ সম্পর্ক, তাতে করে এমনটা হওয়া উচিত ছিল না।

সালাউদ্দিন: না, না সেটি না, এএফসি বা ফিফা যা চায় সেটি হলো সঠিক সিস্টেম। আমিও সেটাই চাই। সেজন্যই চাই ফিফার কনসালট্যান্ট আসুক। ফিফা-এএফসির কাছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ নয়। একটি কথা বলি, এই যে (প্রয়াত) বাদল রায়, মহিউদ্দিন মহি বা তরফদার রুহুল আমিন বা আরো লোকজন কত কথাই বলেছে। সারাদিন টেলিভিশনে হইচই করেছে।

আমি তো কোনো জায়গায় সমস্যা দেখি নাই। স্থানীয়ভাবে অডিট হয়েছে, এএফসি ১২টি অডিট করেছে, ফিফা ১২টি অডিট করেছে। তারা কোনো সমস্যা দেখেনি। আমি প্রতিটি এজিএমের এক মাস আগে অডিট রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছি। এটা ওপেন ছিল। সদস্যরা সেটি পাশ করেছেন। আর এই কাগজ পেয়ে টেলিভিশনের রিপোর্টার লাফালাফি করেছে: পেয়েছি, পেয়েছি… ব্যাংক স্টেটমেন্ট পেয়েছি বলে। তো পেয়েছেন যখন বের করেন, কোথায় টাকা গেল। একমাস আগে এজিএমের রিপোর্টে আমিই তো সব জানিয়ে দিয়েছি।

পবিত্র: বাফুফের বিরুদ্ধে তো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)কাছেও অভিযোগ গেছে। কিন্তু যতদূর জানি কোনো অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি।

সালাউদ্দিন: হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। অথচ আমি কিন্তু দুদকে যাইনি। একটি পা’ও দিইনি দুদক অফিসে। দুদকের কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের কারোর কথাও হয়নি। এমনকি ফাইন্যান্স কমিটির প্রধান বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাম মুর্শেদীও যাননি। ক্লিন শিট পেয়েছি।

পবিত্র: এটা নিয়ে অবশ্য আপনার সমালোচকদের মধ্যেও আলোচনা আছে যে সালাউদ্দিনকে দুদক ধরবে না। কারণ সরকারের সর্বোচ্চ মহলের আশীর্বাদ আপনার ওপর আছে।

সালাউদ্দিন: একদম ভুল কথা। দুদক কি অনেক বড় বড় লোককে ধরে নাই? আসলে অডিট রিপোর্ট সত্যি কথা বলে। আর হ্যাঁ, সরকারের সর্বোচ্চ মহলের আশীর্বাদ থাকলে সমস্যা কোথায়? আপা (প্রধানমন্ত্রী) যদি আমাকে স্নেহ করেন, সেটি তো আমার সৌভাগ্য। আমি তো রাজনীতি করি না। আমি নির্বাচন করেই এসেছি। চারবার নির্বাচন করে এসেছি।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রার্থীর বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়েছি প্রথমবার। আমি তো সাহস করে নির্বাচন করেছি। ওনারা হলে তো দাঁড়ানোর সাহসই পেত না। আমি তিনবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দক্ষিণ এশিয়া ফুটবল ফেডারেশনের (সাফ) সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। আমার বায়োডাটা দেখেন। ৫০ বছর ধরে ফুটবল নিয়ে পড়ে আছি।

পাকিস্তান আমলে মোহামেডানে ফুটবল শুরু। তারপর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া। স্বাধীনতার পর আবাহনীর সালাউদ্দিন হলো আমার পরিচয়। আমি ক্লাবের কোচ ছিলাম, জাতীয় দলের কোচ ছিলাম। তো প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ আমার ওপর যদি থাকে অন্যায় কোথায়?

Rent for add

সর্বশেষ নিউজ

for rent