‘২০০ কোটি টাকার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাব’

বর্ণাঢ্য তার খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার। মাঠ আলো করা খেলা ছেড়ে ক্লাব কোচিং করিয়েছেন, হয়েছেন জাতীয় দলের কোচ। বাংলাদেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় ‘আইকন’ তিনি।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি পদে চার বছর মেয়াদে চতুর্থ দফা নির্বাচিত হয়েছেন তাও এক বছর হয়ে গেল। কাজী সালাউদ্দিন নিজেও জানেন না কখন তিনি বাংলাদেশের ফুটবলের সমার্থক হয়ে গেছেন। দেশের ফুটবল মনস্ক কোটি মানুষের ভালোবাসায় যেমন ভেসেছেন, তেমনি নিন্দা ও সমালোচনার কাঁটাও তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে সমানে।

বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল বিষয়ক নিউজ পোর্টাল ‘ফুটবল বাংলাদেশ ডটকম’কে দেওয়া দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক বিষয় নিয়েই কথা বলেছেন কাজী সালাউদ্দিন। বলেছেন, বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নয়নের জন্য ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেন ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দের আবেদন নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফুটবলবাংলাদেশ.কম এর সম্পাদক পবিত্র কুন্ডু। আজ পড়ুন দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব-

পবিত্র কুন্ডু: প্রথমেই আপনাকে আবারো অভিনন্দন জানাই টানা চতুর্থবার বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায়। আগের তিন দফার চেয়ে কাজেকর্মে যেন চতুর্থ দফায় বেশি সক্রিয় দেখা যাচ্ছে আপনাকে।

কাজী সালাউদ্দিন: ধন্যবাদ। তবে এই কথাটি সত্যি নয় যে আমি চতুর্থদফায় বেশি সক্রিয়। আপনাকে আটকে দিয়ে বলি, আগের ১২ বছরেও আমি সক্রিয় ছিলাম। আমি সবসময়ই সক্রিয় ছিলাম। আমার ৮০ ভাগ সময় ফুটবলকে দিতাম। আপনারা আগে হয়তো সেভাবে দেখেননি। কারণ আমি আগে মিডিয়ার সামনে তেমন আসতাম না। এখন মিডিয়াতে দু’একটা কথা বলি, মিডিয়ার সামনে মাঝেমধ্যে আসি। আমার ব্যবসার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে আমার মেয়ে ও ছেলে। কারণ ওরা আগে আমাকে জোরাজুরি করে ব্যবসার কাজে আনত। আগে আপনারা খেয়াল করেননি।

পবিত্র: প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফুটবলটাকে মাঠে রাখার জন্য এই করোনা ও লকডাউনের মধ্যে ৩০ এপ্রিল প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করে দিলেন। এটি ধন্যবাদ পাওয়ার মতো কাজ।

সালাউদ্দিন: প্রতিশ্রুতি যে এবারই রাখছি তা তো নয়, আগের ১২ বছরেও রেখেছি। তবে এই কৃতিত্ব শুধু আমি একা নিতে পারি না। আমার পুরো বোর্ডকেই তা দিতে হবে। সবাই কাজ করেছে।

পবিত্র: পুরো স্বাস্থ্যবিধি মেনে খেলা চালাতে না পারলে তো করোনা-সংক্রমণের দায় নিতে হবে আপনাদের।

সালাউদ্দিন: সমস্ত রকম করোনাবিধি মেনে খেলা হবে। শূন্য স্টেডিয়ামে খেলা হবে। কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। খেলার আগে করোনা পরীক্ষা হতেই হবে। কোনো দল করোনা পরীক্ষা না করলে তাদের খেলতে দেওয়া হবে না। তাতে প্রতিপক্ষ দল ওয়াকওভার পাবে। আর বাইলজ অনুযায়ী ওয়াকওভার দেওয়া দলটি রেলিগেটেড হবে। নিয়মটি সবাই জানে।

পবিত্র: এর আগে গত নভেম্বরে করোনার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ফুটবল মাঠে নামিয়ে (নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ) দৃষ্টান্ত গড়েছেন। এএফসি বা ফিফা নিশ্চয়ই বাফুফের প্রশংসা করেছে?

সালাউদ্দিন: হ্যাঁ, প্রশংসাসূচক মন্তব্য আমি পেয়েছি। এএফসি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। তবে আমি বাফুফের বা ব্যক্তিগতভাবে প্রশংসা পাওয়ার জন্য এটা করিনি। আমি চেয়েছি যে খেলাটা মাঠে থাকুক, পেশাদার ফুটবলাররা খেলার মধ্যে থাকুক। এটা ওদের জীবিকা। আমি তো তাদের ভাত খাওয়া বন্ধ করতে পারি না। আগে দু’তিন বছর মাঠে ফুটবল ছিল না, তাতে অনেকেই রোজগার করতে না পেরে ফুটবল ছেড়ে দিয়েছে। দু’তিন বছর ফুটবল না হলে একটি ফুটবল প্রজন্মই শেষ হয়ে যায়।

পবিত্র: এমনটা বলা হয়ে থাকে বা আপনার নিন্দুকেরা বলেন বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি তা বলতে পারি না। তবে এটা তো অস্বীকার করতে পারবেন না যে বাংলাদেশের ফুটবল এগোতে পারেনি!

সালাউদ্দিন: ইয়েস অর নো। আগে যখন ফুটবল খেলতাম, ফুটবল তো এত বড় ছিল না এশিয়ায়। পেশাদার লিগ ছিল মাত্র একটি, হংকংয়ে। আমরা কাতারের বিপক্ষেও জিতেছি ঢাকায়, ৮২-৮৩ তে এশিয়ান কাপের বাছাইতে মনে হয়, আমি গোল করেছি। এখন সেই কাতার আর নেই। এখন প্রায় সব দেশেই পেশাদার লিগ চালু হয়েছে। ফিফা আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলারই ফুরসত পায় না অনেকে। আগে এত বেশি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ছিল না।

তখন মালয়েশিয়ায় মারদেকা, কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কাপ আর থাইল্যান্ডে কিংস কাপ হতো। এখন সেসব টুর্নামেন্ট নেই। এখন ফিফা-এএফসির এত এত টুর্নামেন্ট! বিলিয়নস অব ডলার খরচ করে এশিয়ার শীর্ষ দেশগুলো। আমাদের সময় আমরা লিগ খেলতাম, আর আগা খান গোল্ডকাপ-টোল্ডকাপ খেলতাম, এত আন্তর্জাতিক ফুটবল ছিল না। ৩০ মিলিয়ন ডলার প্রাইজমানি এএফসি কাপে, তখন মনে হয় ৩০ হাজার টাকার মতোন ছিল।

তখনকার ফুটবলের সঙ্গে এখনকার ফুটবলের অনেক তফাৎ। টাইম হ্যাজ চেঞ্জড। কিন্তু আমাদের আর্থিক সহযোগিতার পরিমাণ তো বাড়েনি। আমি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাদের জাতীয় দলের বার্ষিক বাজেট কত। তিনি বললেন, ২৫০ মিলিয়ন ডলার। তার মানে ২০০০ কোটি টাকা। জাপান আরো বেশি টাকা ঢালে, কাতার আরও বেশি। তো ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে তো কয়েক কোটি টাকা রাখতে হবে।

পবিত্র কুন্ডু: আপনি কত কোটি চান?

সালাউদ্দিন: কোরিয়ার মিনিমাম ১০% অর্থাৎ ২০০ কোটি টাকা। জাপানের তুলনায় গেলে আরো বেশি।

পবিত্র: কিন্তু জাপান-কোরিয়া তো ফিফার শীর্ষ বিশ বা পঁচিশ দেশের মধ্যে থাকে। ওদের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে?

সালাউদ্দিন: শোনেন, এখন ১০০-২০০ মিলিয়ন ডলার শেখ হাসিনার ইকোনমিতে কিছু নয়। আমাদের দেশের বর্তমান যে ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্রাকচার, সেখানে এটা কোনো টাকাই না। এখন যদি স্পোর্টসের কয়েকটা ফেডারেশনের চার-পাঁচজন প্রেসিডেন্টকে পিক করে ৫০০ কোটি ১০০০ কোটি দিয়ে দেন তাহলে দেখবেন পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।

পবিত্র: ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী, আপনার বন্ধু শহীদ শেখ কামালের বড় বোন শেখ হাসিনার কাছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের দাবি নিয়ে গিয়ে আপনি থোক বরাদ্দ হিসেবে ২০০ কোটি টাকা চেয়ে দেখুন না!

সালাউদ্দিন: আমি চেষ্টা করছি। আমি টার্গেট করেছি, আলাপ চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু গত ছয় বছরে আমার বিরুদ্ধে কিছু লোক অবিরাম যেভাবে নানা অভিযোগ এনেছেন তাতে আমার পক্ষে তার কাছে টাকা চাইতে খুব সমস্যা হয়। আমাকে তো কনভিক্টই (অপরাধী) বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুদকে নালিশ গেছে। আমি কীভাবে গিয়ে টাকা চাই বলেন তো?

পবিত্র: চতুর্থ দফা নির্বাচনে জিতে ওই অভিযোগ তো মুছে ফেলেছেন। আবার নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর আস্থা অর্জন করেছেন। এখন চেষ্টা করতে পারেন।

সালাউদ্দিন: এবার আমি আসলেই চিন্তা করছিলাম যে ইলেকশনের পর গিয়ে ভালোভাবে চাপ দেব। কিন্তু কপালটা খারাপ, ওই সময়ে করোনায় পড়ে গিয়ে যেতে পারলাম না। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হলে আমি সুযোগমতো উনার কাছে যাব। আমি বলব, আমি থাকি বা না থাকি এই টাকার বরাদ্দটা আপনি স্থায়ীভাবে দিয়ে দেন।

পবিত্র: কিন্তু অভিযোগ আছে যে বাফুফে স্পনসর আনতে পারে না। এই যে গত দুটি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের কোনো স্পনসর ছিল না। স্পনসর না আনতে না পারলে ফেডারেশনের তহবিল তো বাড়বে না।

সালাউদ্দিন: আমি তো প্রথম চার-পাঁচ বছর স্পনসর এনেছি। কিন্তু আপনারা মিডিয়ারা যেভাবে বাফুফের নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন, বলেছেন ফুটবল মরে গেছে, সালাউদ্দিন চোর। বলেন তো এসব শুনে কোন স্পনসর এগিয়ে আসবে? তারপরও তো আমি ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে স্পনসর আনি।

এই যে কিছুদিন আগে ঢাকা ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাঈদকে লাঞ্চে দাওয়াত দিয়ে বললাম একটা উপকার করো। আমাদের মেয়েদের ফুটবল টিমটাকে স্পনসর করো। বছরে দুই কোটি টাকা দাও। সে বলল সালাউদ্দিন ভাই, ওকে, ডান।

এই টাকাটা দিয়েই কিন্তু ৪০টি মেয়ের বেতন দিই। ক্যাম্প চালাই। ওদের বেতন দিই কেন, এটা হলে ওদের বাবা-মা ওদের বিয়ে দিয়ে দেবে না। আরও কিছুদিন ওদের খেলার মধ্যে পাব। টাকাটা হাতে পেলে মা-বাবা খুশি থাকে। কিন্তু মিডিয়া ক্রমাগত নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে গেলে স্পনসর আনাটা খুব কঠিন হয়। আমার তো মুখ দেখাতে হবে।

পবিত্র: কিন্তু গত নির্বাচনের আগে দুদক যেহেতু আপনাকে ক্লিন শিট দিয়েছে, এসব অভিযোগ আর ধোপে টেকে না। এবার তো বলতে পারবে না সালাউদ্দিন চোর। চোর হলে আপনি চতুর্থবার নির্বাচিত হতে পারেন না।

সালাউদ্দিন: হ্যাঁ, আমি চেষ্টা করছি। একটু সময় দেন। এখন তো করোনার মধ্যে পড়ে গেলাম। করোনা না গেলে ব্যক্তিগতভাবে কোথাও যেতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেই দেখা করতে যেতে পারছি না। আমি উনার সঙ্গে দেখা করতে পারলে ১০টা কথা বলতে পারব।

পবিত্র: তাহলে আপনার পরিকল্পনা হলো আপনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেন এবং ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাইবেন।

সালাউদ্দিন: ঠিক তাই। আমি অবশ্যই যাব।

Rent for add

সর্বশেষ নিউজ

for rent